সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার প্রধান দুই আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। এছাড়া পুলিশ সদস্য নন্দ দুলাল, রুবেল শর্মাসহ ৬ জনের যাবজ্জীবন ও ৩ এপিবিএন সদস্যসহ ৭ জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে।
সোমবার আদালতে ১৫ আসামির উপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করেন বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল।
কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল বেলা আড়াইটার দিকে মেজর সিনহা হত্যা মামলার ৩০০ পৃষ্ঠার এ রায় পড়া শুরু করেন।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানান, এ হত্যা পরিকল্পিত তাই সাক্ষ্য প্রমাণে কার কী অপরাধ দাঁড়িয়েছে সেসব তুলে ধরার পর অপরাধ অনুসারে প্রধান দুই অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছে আদালত।
এর আগে সোমবার বেলা পৌনে ১টার দিকে কক্সবাজার আদালতে আনা হয় আসামিদের। এরপর তাদের নেয়া হয় জেলা দায়রা জজ আদালতের কাঠগড়ায়।
এর আগে মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মো. লিয়াকত আলী ও প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ আসামিকে দুপুর ২টায় কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে আদালতের এজলাসে তোলা হয়। রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই আদালত চত্বরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
আদালতের প্রবেশ পথ, জেলা প্রশাসক কার্যালয় এলাকা ও কাঁচা বাজার এলাকায় পুলিশের মোট ছয়টি চেকপোস্ট বসানো হয়।
সকালে আদালতে প্রবেশের সময় দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা ফটকে অবস্থান নিয়ে আছেন। কাউকে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা প্রবেশ করতে দিচ্ছেন। আদালতের ভবনগুলোর বিভিন্ন তলাতেও পুলিশের অবস্থান দেখা গেছে।
এদিকে ছেলের হত্যার রায় শুনতে মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের মা নাসিমা আক্তার এখন কক্সবাজারের অবস্থান করছেন। মামলার বাদী ও সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।
১৫ আসামির মধ্যে সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া ছয় জন হলেন, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং এএসআই সাগর দেব এবং পুলিশের তিন সোর্স নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ।
একদম খালাস পেয়েছেন, বরখাস্ত কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, বরখাস্ত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, বরখাস্ত এপিবিএনের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান, বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ।
দেড় বছর আগে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
হত্যাকাণ্ডের ৪ দিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলায় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে প্রধান আসামি করা হয়। প্রদীপ কুমার দাশকে ২ নম্বর ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে কর্মরত উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিতকে ৩ নম্বর আসামি করা হয়। আদালত কক্সবাজারের র্যাব-১৫-কে মামলাটির তদন্তভার দেন।
সিনহা হত্যার ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়েছে। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়। তিনটি মামলার দুটি মাদক রাখার অভিযোগে এবং একটি পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে।
মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভূক্ত করার পর আদালত তদন্তভার দেয় র্যাবকে । র্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এরপর ২০২১ সালের ২৭ জুন আদালত ১৫ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরুর আদেশ দেয়।
২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষী দেন। ৬ ও ৭ ডিসেম্বর আসামিরা আদালতে জবানবন্দি দেন। সবশেষে ৯ থেকে ১২ই জানুয়ারি পর্যন্ত মামলায় উভয়পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত ৩১ জানুয়ারি মামলার রায়ের দিন ঠিক করে।
রাষ্ট্র ও বাদীপক্ষ বলছে, এটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ১৮ মাসের মাথায় রায় ঘোষণা হল এ মামলার। বিচারিক কার্যক্রম শুরু করে মাত্র ৩৩ কার্যদিবসে শেষ হয়েছে মামলাটির পরবর্তী কাজ।
publish by :https://www.independent24.com