টানা তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন ওবায়দুল কাদের। স্বাধীন বাংলাদেশে দলটির কোনো নেতাই টানা তিনবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতে পারেননি। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গতকাল দশমবারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে সভাপতি হিসেবে সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্ব পালনের রেকর্ডটি আরও দীর্ঘ হলো।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র এক বছর বাকি থাকায় ভোটের দিকে চোখ রেখে দলটি এবারের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে বড় কোনো পরিবর্তন আনেনি। দলের বেশির ভাগ নেতাই একই পদে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। এবারের কমিটিতে কোনো নতুন মুখ নেই। দলটির কমিটির সদস্যসংখ্যা ৮১। রমেশ চন্দ্র সেন, নুরুল ইসলাম নাহিদ ও আব্দুল মান্নান খান সভাপতিমণ্ডলী থেকে বাদ পড়েছেন। তাঁদের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়েছে। এ ছাড়া দুজনের পদোন্নতি হয়েছে। তাঁরা হলেন সুজিত রায় নন্দী ও আমিনুল ইসলাম আমিন। সভাপতিমণ্ডলীর জ্যেষ্ঠ সদস্য হিসেবে এবারও একজন নারীকে রাখা হয়েছে। তিনি মতিয়া চৌধুরী। গত কমিটিতে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ছিলেন। এর আগে ১৯৮১ সাল থেকে আমৃত্যু জ্যেষ্ঠ নারী সদস্য ছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন।
শনিবার বেলা ৩টায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। কাউন্সিল অধিবেশন শুরুর পর দেশের আট বিভাগের একটি করে জেলা থেকে আটজন কাউন্সিলর বক্তব্য দেন। এর পর একে একে বাজেট উপস্থাপন, ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেগুলো সভায় গ্রহণ করা হয়। এরপর দলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করে।
নির্বাচন কমিশন প্রথমে সভাপতি এবং পরে সাধারণ সম্পাদক পদে নাম প্রস্তাব চায়। কাউন্সিলরদের মধ্য থেকে সভাপতি পদে শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদেরের নাম প্রস্তাব করা হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর নির্বাচন কমিশনের প্রধান ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের নাম ঘোষণা করেন।
১৯৮১ সালে দলের ১৩তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে প্রথমবার সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। এরপর থেকে দলের প্রতিটি সম্মেলনেই তিনি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। গতকাল দলের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দশমবারের মতো সভাপতি হলেন শেখ হাসিনা। তিনি এ নিয়ে টানা ৪১ বছর দলের সভাপতি পদে আছেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আর কোনো নেতা এতবার সভাপতি নির্বাচিত হতে পারেননি।
ওবায়দুল কাদের ২০১৬ সালে প্রথমবার দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার, এবার তৃতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। এর আগে মাত্র দুজন নেতা টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁরা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ। তবে তাঁরা দুজনই পাকিস্তান আমলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আর কোনো নেতা টানা তিন মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক হতে পারেননি।
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের সভাপতিমণ্ডলী, উপদেষ্টা পরিষদ, সংসদীয় বোর্ড, স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ড, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, জাতীয় পরিষদের নেতাদের নাম ঘোষণা করেন।
সভাপতিমণ্ডলীতে আছেন যাঁরা
মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফর উল্যাহ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, শ্রী পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য, আব্দুর রাজ্জাক, মুহাম্মদ ফারুক খান, শাজাহান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কামরুল ইসলাম, সিমিন হোসেন রিমি ও মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। এঁদের মধ্যে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সভাপতিমণ্ডলীতে নতুন মুখ। এর আগে তিনি কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন।
সংসদীয় বোর্ডে আছেন যাঁরা
শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, কাজী জাফর উল্যাহ, রমেশ চন্দ্র সেন, ওবায়দুল কাদের, কাজী রশিদুল আলম ও দীপু মনি।
স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডে আছেন যাঁরা
শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, কাজী জাফর উল্যাহ, আব্দুর রাজ্জাক, মুহাম্মদ ফারুক খান, রমেশ চন্দ্র সেন, ওবায়দুল কাদের, কাজী রশিদুল আলম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, মাহবুবউল আলম হানিফ, দীপু মনি, হাছান মাহ্মুদ ও আব্দুস সোবহান গোলাপ।
উপদেষ্টা পরিষদে আছেন যাঁরা
আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মসিউর রহমান, ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, কাজী আকরাম উদ্দিন, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, শফিক আহমেদ, সতীশ চন্দ্র রায়, আব্দুল খালেক, আ ফ ম রুহুল হক, সৈয়দ রেজাউর রহমান, অনুপম সেন, হামিদা বানু, হোসেন মনসুর, সুলতানা শফি, এ এন এম ফখরুল ইসলাম মুন্সি, মুহম্মদ জমির উদ্দিন, খন্দকার গোলাম মাওলা নকশাবন্দি, মির্জা এম এ জলিল, প্রণব কুমার বড়ুয়া, আব্দুল হাফিজ মল্লিক, সাইদুর রহমান, খন্দকার বজলুল হক, ইয়াফেস ওসমান, রশীদুল আলম, কাজী সেরাজুল ইসলাম, চৌধুরী খালেকুজ্জামান, মোজাফফর হোসেন পল্টু, সালমান এফ রহমান, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, আতাউর রহমান, এ কে এম রহমতুল্লা, মতিউর রহমান, শামসুল আলম, মতিউর রহমান খান, জহিরুল হক খোকা, রমেশ চন্দ্র সেন, নুরুল ইসলাম নাহিদ, আব্দুল মান্নান খান, হারুনুর রশীদ ও হাবিবুর রহমান সিরাজ।
কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সম্পাদকমণ্ডলীতে কে কোন পদ পেলেন
কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সম্পাদকমণ্ডলীতে খুবই সামান্য পরিবর্তন এসেছে। শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশীদকে তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়েছে। গত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে সাখাওয়াত হোসেন শফিক বাদ পড়েছেন। সম্পাদকমণ্ডলীর দুজন নেতা পদোন্নতি পেয়েছেন। ঘোষিত কমিটিতে তিনটি পদ ফাঁকা রাখা হয়েছে। চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের অবস্থানের ক্রমের পরিবর্তন ঘটেছে।
সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নতুন পদ পেয়েছেন সুজিত রায় নন্দী। তিনি আগের কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে বাদ পড়া সাখাওয়াত হোসেন শফিকের স্থানেই সুজিত রায়কে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। বিগত কমিটির উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিনকে ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতির ঘোষিত নামের ক্রমানুসারে চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেন- হাছান মাহ্মুদ, মাহবুবউল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও দীপু মনি। আগের কমিটিতে হানিফের নাম হাছান মাহ্মুদ ও দীপু মনির পরে ছিল। বাহাউদ্দিন নাছিমের নাম দীপু মনির পরে ছিল।
আট সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আছেন আহমদ হোসেন, বি এম মোজাম্মেল হক, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, এস এম কামাল হোসেন, মির্জা আজম, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ও সুজিত রায় নন্দী।
কোষাধ্যক্ষ পদে এবারও আছেন এইচ এন আশিকুর রহমান। অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ, আইন বিষয়ক সম্পাদক নজিবুল্লাহ হিরু, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক সিরাজুল মোস্তফা, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুর, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক জাহানারা বেগম, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক শামসুন নাহার চাঁপা, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মো. সিদ্দিকুর রহমান, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক রোকেয়া সুলতানা, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক জাহানারা বেগম ও উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান।
যুব ও ক্রীড়া, শ্রম ও জনশক্তি এবং প্রচার ও প্রকাশনা উপসম্পাদক—এই তিনটি পদ ফাঁকা রাখা হয়েছে।
কমিটি ঘোষণার সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জানান, রীতি অনুসারে দলের সভাপতিমণ্ডলীর পরবর্তী সভায় কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য নির্বাচন হবে।