প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘নির্বাচনে আমরা কোনোভাবেই পক্ষপাতিত্ব করব না, সর্বশক্তি দিয়ে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করব। আমরা ডিগবাজিও খাব নাÑ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আস্থা রাখুন। তবে আস্থা রাখতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলেও হবে না। কঠোর নজরদারিতে আমাদেরও (ইসিকে) রাখুন। যদি কোনো অনিয়ম খুঁজে পান তা প্রকাশ করুন। কারণ আমরা কি আসলেই সাধু পুরুষ, না ভেতরে ভেতরে অসাধু, সেই জিনিসটা আপনারা যদি নজরদারি না রাখেন তাহলে আপনাদেরও দায়িত্ব পালনে অবহেলা হতে পারে।’ সিইসি আরও বলেন, ‘আমরা কোনো কিছুতেই মাইন্ড করি না। আপনারা আমাদের সমালোচনা করবেন কঠোরভাবে। আমাদের অবশ্যই চাপে রাখবেন। আমাদের সতর্কতা থাকবে। আমাদের ওপর অনাস্থা থাকতেই পারে। সে অনাস্থা আমাদেরই দূর করতে হবে কাজের মধ্য দিয়ে।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গতকাল মঙ্গলবার ছিলো ধারাবাহিক এই সংলাপের অষ্টম দিন। এদিন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, ইসলামীঅ আন্দোলন বাংলাদেশ এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এপিপি’ন সঙ্গে ইসির সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। গত ১৭ জুলাই থেকে চলছে ধারাবাহিক এই সংলাপ। ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে শেষ হবে ইসির এ কার্যক্রম।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর নেতৃত্বে দলটির ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল। আর কমিশনের পক্ষ থেকে ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনানের নেতৃত্বে চার নির্বাচন কমিশনার এবং ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আলোচনায় নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, ভোটে ইভিএমের ব্যবহার বন্ধ, নির্বাচনে সেনা মোতায়েনসহ ১১ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘কোন ধরনের অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে তা ইসিকে জানান। আপনারা আমাদের অবশ্যই চাপে রাখবেন। আমি বিশ্বাস করি, এটার প্রয়োজন আছে। আমাদের থেকে কোন অনিয়ম লক্ষ্য করলে তা প্রকাশ করে দেবেন। আমরা কোন ধরনের পক্ষপাত নয়, দায়িত্ব পালন করতে এসেছি। কারণ আমরা প্রতিশ্রুতি যে দিচ্ছি, তার কিছু মূল্য থাকা উচিত। একেবারে যে আমরা ডিগবাজি খেয়ে যাব, তা তো নয়।’
নির্বাচনের সময় অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান কাজী হাবিবুল আউয়াল। এসময় তিনি নির্বাচনে অর্থশক্তিকে কীভাবে সামাল দেয়া যাবে সে বিষয়েও পরামর্শ চান। বলেন, ‘এই অর্থ নিয়ন্ত্রণ করব কীভাবে? কাগজে-কলমে পাঁচ লাখ টাকা করা হলেও যদি প্রকৃত খরচ পাঁচ কোটি টাকা হয় কীভাবে আমি আপনাকে ধরব? এটা অসম্ভব, এজন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমাদের চর্চাটা অপসংস্কৃতি হয়ে গেছে। পয়সা ঢেলে মাস্তান ভাড়া করছে। একজন প্রফেশনাল কিলারকে হায়ার করতে খুব বেশি পয়সা লাগে না, আজকাল যেটা হয়েছে। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সবাইকে সামাজিক আন্দোলন করতে হবে। মাঠে আপনাদের থাকতে হবে। আমাদের তথ্য দিলে আমরা আপনাদের সাহায্য করব। আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, এই প্রতিশ্রুতির কিছু মূল্য থাকা উচিত। একেবারে যে আমরা ডিগবাজি খেয়ে যাব তা তো নয়। সেটা হওয়ার কথা নয়।’
ভোটে ইভিএমের ব্যবহার প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ‘লাঠি দিয়ে, হকিস্টিক দিয়ে ইভিএম মেশিনটা ভেঙে ফেলতে পারবেন, কিন্তু এখানে ভোটের নড়চড় হবে না। ২০১৮ সালের যে নির্বাচনের কথা আপনারা বলেছেন- না, ওভাবে নির্বাচন হবে, এটি আপনারা আশা করেন না। আমরা সেটি জানিও না, দেখিওনি। নির্বাচন নির্বাচনের আইন অনুযায়ী হবে। সময় দেওয়া হবে। ভোটাররা যাবেন। ভোট দিতে থাকবেন। তবে ইভিএম নিয়ে আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। ব্যালট পেপারে একটা অসুবিধা আছে, ব্যালট ছিঁড়ে সিল মেরে দেয়া যায়। কাগজের যে সমস্যা, আমি নিজেও বাক্স পুড়িয়ে দিতে পারি। ইভিএমে লাঠি দিয়ে, হকিস্টিক দিয়ে বাক্স ভেঙে ফেলতে পারবেন, কিন্তু এখানে ভোট নষ্ট হবে না। একটা কেন্দ্র দখল করে একজন একশ’টা করে পাঁচজনে মোট যদি পাঁচশটা ভোট দেয়, তাহলে ভোটের হার তো অনেক বেশি হয়। বিভিন্ন জায়গায় সমস্যা আছে। আমি যেটা বলতে চাইছি, সমস্যাগুলো ব্যালেন্স করে যতদূর সম্ভব একটা অর্থবহ, নিরপেক্ষ এবং দুর্নীতিমুক্ত নির্বাচন করা সম্ভব।’
দুপুরে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে যোগ দেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল। এসময় আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে ৩শ’ আসনেই ইভিএমে ভোটগ্রহণসহ ৭ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন বিকল্পধারার নেতারা।
এসময় দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাহি. বি চৌধুরী নির্বাচন কমিশনকে মানুষের মনে বিশ্বাস স্থাপনের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ যদি বিশ্বাস করে বর্তমান ইসির অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, তাহলে সবাই নির্বাচনে আসবে। ভোটকেন্দ্রে সেনাবাহিনীর পোশাক দেখলেই মানুষের আস্থা বেড়ে যায়। আসলেই ভোট হবে কি না, কীভাবে হবে, সেটা বিষয় না। সেনাবাহিনী যদি ভোটকেন্দ্রে থাকে, পাঁচ জন করেও যদি থাকে তবে অনেক আস্থা বাড়ে। ৩শ’ আসনেই ইভিএমে ভোটের মাধ্যমে বড় ধরনের পরিবর্তন নির্বাচনি ব্যবস্থায় আসবে। তবে এর আগে ইভিএম সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার করার দরকার হবে।’
পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘রাজনীতি থেকেই গণতন্ত্রের জন্ম। অনেক আগে যখন ক্ষমতা নিয়ে কথা হয়, তখন আস্তে আস্তে উনারাই নির্বাচনের জন্য একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সৃষ্টি করলেন। সেই নির্বাচনই যদি বাঁচিয়ে রাখা না যায়, তাহলে রাজনীতি উধাও হয়ে যাবে; যা থাকবে- তাকে আর রাজনীতি বলা যাবে না, গণতন্ত্র ও বলা যাবে না। তখন অন্য কোন তন্ত্রে আপনারা চলে যান, সেটা ভিন্ন কথা।’
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কর্তা হিসেবে এই সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সুষ্ঠু নির্বাচন করার ওপর জোর দিচ্ছেন শুরু থেকেই। আগের ইসি এমনকি নিজেরও সফলতা-ব্যর্থতার পরিমাপ করতে নারাজ তিনি। তার ভাষ্য, সেটা জনগণ পারসিউ করবেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্বাচন যথেষ্ট কঠিন একটা কাজ দাবি করে সিইসি বলেন, ‘এই কঠিন কাজটি করতে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা লাগবে। আপনাদের সক্রিয় সহায়তা লাগবে। আমি ফেল করলাম, পুরোপুরি সফল হলাম, না আংশিক সফল হলাম, নাকি পুরোপুরি ব্যর্থ হলাম এটা নির্ভর করবে জনগণ কীভাবে পারসিউ করে। কোন বাটখারা দিয়ে সেটা মাপ করা যাবে না।’
এসময় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেই যে অবিচার বা ভোট চুরি হবে না তা নয়, সেটা হলে যা হয় একটা ভারসাম্য তৈরি হয়। যদি বড় বড় দলগুলো থাকে তাদের যে কর্মী-সমর্থকরা তারাই আমার কাজটাক সহজ করে দেয়। এই ভারসাম্য ক্রিয়েট করে।’ নির্বাচন কমিশনের অসামঞ্জস্যমূলক যে কোন কাজের সমালোচনা করতে এবং প্রকাশের আহ্বানও জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
সংলাপে নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা বলেন, ‘আস্থা পাওয়ার জন্য আমরা অবশ্যই চেষ্টা করে যাব। আপনারা একটু শুধু বলুন আমরা আস্থার জন্য কাজ করছি কি না। আপনারা চোখ-কান খোলা রাখুন, দেখুন আমরা কতটুকু করতে পারি। ভুল হলে ধরিয়ে দিন। পেপার-পত্রিকায় যা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে আমরা কিছুই করছি না। মনে হচ্ছে যে যাবে বৃন্দাবন, সেই হবে রাবণ। আপনারা যদি একটু ফিডব্যাক দেন তাহলে আমরা আরেকটু উজ্জীবিত হই। আমাদের কতটুকু ইতিবাচক, কতটুকু নেতিবাচক; তা যদি বলেন তাহলে আমরাও বলতে পারি যে জনগণের কাছে আমাদের কাজ পৌঁছে গেছে। নিজেদের কাজ নিজেদের কাছে বোঝা কঠিন। আমরা আস্থা অর্জনের চেষ্টাই করছি না এই চিন্তা থেকে আপনারা একটু বেরিয়ে আসুন।’
নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেন, ‘আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা প্রতিহত করার জন্য। একজন মা যদি ভিডিও কলে তার ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পারেন তবে ইভিএম মেশিনে একটি মাত্র চাপ দিয়ে ভোট দিতে পারবেন না? ইভিএম মেশিন নিয়ে অবিশ্বাস থাকা উচিত নয়। এর পেছনে যারা আছে, আমি আছি, আমাকে অবিশ্বাস করতে পারেন। আপনারা বলেন আই ওয়াশ, আমি জানি, আল্লাহ তো জানেন আই ওয়াশ কি না।’