আজকের প্রজন্ম ৭ই মার্চের ভাষণটি বার বার শুনেছে, তাদের মননশীলতা এবং বিশ্লেষণশক্তি আজ অতীব প্রগাঢ়। যারা যে দলমত আদর্শে ও চেতনায় বিশ্বাস করুক না কেন, আমার সঙ্গে প্রায় সবাই একমত হবেন ৭ই মার্চের ভাষণটি স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল। শুধু শব্দচয়ন, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং পাকিস্তানি সামরিক জান্তাসমর্থিত জুলফিকার আলী ভুট্টোর কূটকৌশল সম্পর্কে প্রখর ও তীক্ষ্ন দৃষ্টি বাংলাদেশের জনমতকে তো বিভ্রান্ত করতে পারেইনি, বরং ছাত্র-শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, ধনী-দরিদ্র সবাইকে একটি অদৃশ্য রাখিবন্ধনে আবদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যালোকে অভিষিক্ত হওয়ার।
ভাষাশৈলী, প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়ন, অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ- সবকিছু মিলিয়ে একটা অদ্ভূত রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে স্বাধীনতার পূর্ণ ঘোষণাই প্রদত্ত হয়েছিল ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিতে। কিন্তু অতি সতর্কতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শব্দচয়নের যে কুশলী পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, তাতে বিচ্ছিন্নতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার কোনো সুযোগ তিনি রাখেননি। আমি তাঁর নিজের প্রদত্ত শতাধিক ভাষণ নিজ কানে শোনার সৌভাগ্যের অধিকারী। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তো বটেই, তাঁর নির্দেশ-নির্দেশনাকে উপলব্ধি ও মননশীলতায় পরিণত করার জন্য এবং তাঁর বাগ্মিতাকে জ্ঞানপিপাসু ঋষিবালকের মতো অনুশীলন করার জন্য আমি একান্তচিত্তে তার বক্তৃতা শুধু শ্রবণই করিনি; অনুধাবন করেছি, উপলব্ধি করেছি, আত্মস্থ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টাও চালিয়েছি। সত্যতার খাতিরে এ বাধ্যবাধকতাকে স্বীকার করতেই হবে, তাঁর নিজের প্রদত্ত কোনো ভাষণের তুলনা ৭ই মার্চের ভাষণের সঙ্গে হতে পারে না। তিনি তেজস্বী বক্তা ছিলেন, বাগ্মী ছিলেন।
এটা অস্বীকার করা না গেলেও ৭ই মার্চে শব্দচয়ন থেকে শুরু করে তাঁর প্রয়োগ এতটাই কার্যকর ছিল, ওই সভায় উপস্থিত সবার মন ও মননশীলতাকে প্রচণ্ড আবেগে শুধু অভিভূতই করেনি, স্বাধীনতার চেতনাকে প্রত্যয় ও প্রতীতিতে পরিণতই করেনি, বরং নিজ আঙ্গিকে সবাই এ প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা নিয়ে ফিরেছে যে একসাগর রক্তের বিনিময়ে হলেও পরাধীনতার বক্ষবিদীর্ণ করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে।
আমি সমস্ত উপলব্ধি ও সত্তায় আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আমার স্থির ধারণা, ৭ই মার্চে বাংলাদেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য আল্লাহর রহমতে তিনি উজ্জীবিত ছিলেন। ওই ভাষণটি স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিপূর্ণ প্রত্যয় সৃষ্টির লক্ষ্যে সমস্ত জাতীয় চেতনাকে এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ ও অঙ্গীকারাবদ্ধ করেছিল।
ভাষণটি গোটা জাতিকে এমনভাবে উদ্বেলিত করেছিল যে, পৃথিবীর কোনো একক বক্তৃতায় এরূপ দৃষ্টান্ত আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকেই আবেগ আপ্লুত হৃদয়ে, অভিভূত চিত্তে ৭ই মার্চের ভাষণটিকে গ্যাটিসবার্গে আব্রাহাম লিংকনের বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করে থাকেন।
আমি এই তুলনাটি করতে নারাজ। কারণ দুটি বক্তৃতার প্রেক্ষাপট এবং আঙ্গিক ছিল ভিন্নতর। গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী আমেরিকার গৌরবদীপ্ত মঞ্চে দাঁড়িয়ে আব্রাহাম লিংকন ওই ভাষণটি দিয়েছিলেন। সামাজিক দুর্যোগের মেঘ সরে গিয়ে যখন আমেরিকার পূর্বদিগন্তে হাস্যোজ্জ্বল সূর্য উদ্ভাসিত, তখন আমেরিকার বিজয়ী নেতা সারা বিশ্বের জন্য জগৎখ্যাত ভাষণটি দেন (Govt. of the people, by the people, for the people, can&_t perish from the earth.) কিন্তু ৭ই মার্চের প্রেক্ষাপটটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলার দিগন্তবিস্তৃত আকাশ ঘনকালো মেঘে ঢাকা। একদিকে নিদারুণ অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে বুকভরা প্রত্যাশা। স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস ও আকাঙ্ক্ষা তখন পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করার জন্য উদ্গ্রীব। বাংলার মানুষের এই প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই ৭ই মার্চের ভাষণটি প্রদত্ত। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য যে- হরতাল, অসহযোগ, অবরোধের মধ্যদিয়ে অহিংস ধারাকে অব্যাহত রেখে চলছিল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। এর পূর্বে ৩রা মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস ও সুশৃঙ্খলভাবে এবং নাশকতার সম্পর্কে সতর্ক থেকে আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান।
শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, আমরাও সমস্ত সত্তা দিয়ে বিশ্বাস করতাম, জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সংসদ স্থগিত ঘোষণা থেকে শুরু করে সামরিক জান্তার সহায়তায় যে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিলেন, তাতে কোনো অবস্থাতেই ৬ দফাকে সংবিধানে সন্নিবেশিত হতে তিনি দেবেন না। কিন্তু আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অপপ্রচার করার উপকরণের জন্য তার এবং সামরিক জান্তার তীক্ষ্ন দৃষ্টি ছিল, যাতে পৃথিবীর কাছে একতরফাভাবে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই ভাষণটি দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে তিনি যখন ৪টি শর্ত জুড়ে দিলেন ইয়াহিয়া খানের সামনে, তখন ভুট্টোর কূটকৌশল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
প্রথমত- তিনি যখন পাকিস্তানি সৈন্যদের বললেন, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে ফিরে যাও। তোমাদের কেউ কিছু বলবে না। তখন বিশ্ব জনমত উপলব্ধি করলো ৬ দফা-ভিত্তিক একটি সম্মানজনক সমঝোতায় উত্তরণে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই।
দ্বিতীয়ত- যারা ’৭০-এর নির্বাচনকেও অস্বীকার করে কোনো ম্যান্ডেটপ্রাপ্তির আগেই সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিতে চেয়েছিল, অতি বিপ্লবের প্রসব যন্ত্রণায় অস্থির এ অংশটি চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স থেকে জনগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের একতরফা ঘোষণা দান করবেন। তাদের অবাস্তব দূরাশা পূরণ না করে বঙ্গবন্ধু প্রখর থেকে প্রখরতর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন।
তৃতীয়ত- আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থিদের যে অংশটি এ অভিলাষও ব্যক্ত করেছিল যে, পুরো পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা যখন আমরা পেয়েছি, তখন ক্ষমতা আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতেই হবে এবং পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা ২৩ বছরের নির্মম শোষণের শুধু প্রতিশোধই নেবো না, জৌলকারের মতো তারা যে বুকের তাজা রক্ত চুষে নিয়েছে, বিন্দু বিন্দু করে তার হিসাব আদায় করে নেবো। হয়তো তাদের জন্যই বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ছিল, ১৯৫৪ সালে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। (অর্থাৎ- সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ওরা আমাদের ক্ষমতা দেবে না)।
চতুর্থত- আমরা নির্বাচনের আগে সশস্ত্র বিপ্লবের বিরোধিতা করে ’৭০-এর নির্বাচনে স্বাধীনতার ম্যান্ডেট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। ক্রমাগত বঙ্গবন্ধুকে এই চেতনায় উজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছি যে, এ ম্যান্ডেটটিকে স্বাধীনতা অর্জনের অমোঘ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। আঘাত হানলে আমরা প্রত্যাঘাত হানবো। আক্রমণ করলে প্রতি-আক্রমণ চালাবো।
ওদের অস্ত্র এবং ষড়যন্ত্রের শক্তি যত প্রখর ও প্রকট হোক না কেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যয়, প্রতীতি, বিশ্বাস, সাহস এবং সমর্থনকে আপনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনবো। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দিবালোকের মতো সত্যে পরিণত হয়েছে আমাদের সেই প্রত্যয়। সভায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বজ্রনির্ঘোষে ঘোষণা করলেন- রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, বাংলাকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ! প্রত্যয়দৃঢ় কণ্ঠে তাঁর অকুতোভয় উচ্চারণ ছিল, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। আমি ক্ষমতা চাই না, আমি বাংলার মানুষের মুক্তি চাই। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
ভাষণটি শুধু সাধারণ বাঙালিদেরই নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও এমনভাবে উজ্জীবিত করেছিল যে, ৭০’র নির্বাচনে অংশ না নেয়া মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও বঙ্গবন্ধুর উপর অকৃত্রিম আস্থা রাখলেন। তিনি ১১ই মার্চ পল্টন ময়দানে এবং ১৭ই মার্চ রংপুরের জনসভায় বললেন, ‘আমার মুজিবরকে অবিশ্বাস করিও না। তাহার নেতৃত্বেই দেশ ও জাতি মুক্ত হইবে।’ তিনি ইয়াহিয়া খানকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তালবাহানা ছাড়ো। আমার মুজিবের দাবি মানিয়া লও।’ এনডিএফ- এর নেতা মরহুম নুরুল আমীন সাহেব ১০ তারিখের গোলটেবিল অস্বীকার করে বললেন, শর্তহীনভাবে শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। ওলি খান, এয়ার মার্শাল আজগর খান, বাকী বেলুচসহ আরও অনেক পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাও শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের তীব্র দাবি উপস্থাপন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানেও ভুট্টোর সামরিক জান্তার শক্তি অনেকখানি দুর্বল হয়েছিল। এটাও ৭ই মার্চের একটা বিশেষ অর্জন।
ভাষণের বিশ্লেষণে আমার প্রত্যয়দীপ্ত বিশ্বাসটিকে উন্মোচিত করার জন্য আমি একটি তথ্য উপস্থাপন করতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে (ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসার একদিন পর ১৭ই মার্চ) একজন বিদেশি সাংবাদিক (সম্ভবত মার্ক টালি) প্রশ্ন করলেন- আপনাদের নেতা, যাকে আপনারা জাতির পিতা ঘোষণা করেছেন, তিনি ৭ই মার্চের ভাষণে যে চারটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন, সেই চারটি শর্ত পরিপূর্ণ মেনে নিলেও তো পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকে থাকে। বাংলাদেশ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন পেলেও তো স্বাধীনতা অর্জিত হয় না। আপনারা তো স্বাধীনতার সুস্পষ্ট প্রত্যয় ও প্রতীতি ঘোষণা করে আন্দোলন করছেন। যদি ইয়াহিয়া খান চারটি প্রস্তাবই পরিপূর্ণভাবে মেনে নেন, তখন আপনাদের অবস্থান কী হবে? আপনারা কি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অমান্য করে স্বাধীনতার দাবি অব্যাহত রাখবেন, নাকি আন্দোলনের গতি স্তিমিত করে দেবেন? স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে আমি এর উত্তর দিয়েছিলাম।
বলেছিলাম, অপেক্ষায় থাকুন। ইতিহাস প্রমাণ করবে। ভয়ভীতি, নির্যাতন-নিগ্রহের আতঙ্ক অথবা কোনো প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা ৭ই মার্চের প্রদত্ত স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান থেকে বঙ্গবন্ধুকে একবিন্দু নড়াতে পারবে না। আমরা যে কর্মসূচি পালন করেছি, করছি এবং আগামীতেও করবো- সেটি তাঁরই নির্দেশে। আমরা তাঁরই চিন্তায় শানিত, তাঁরই চেতনার উত্তরাধিকারী। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, জনগণের নাড়ির স্পন্দন তিনি বুঝতে পারেন এবং এখানে তিনি অনন্য সাধারণ। তার আঙ্গিকেই তিনি কর্মসূচি দেবেন। ৭ই মার্চের ঘোষণাটি সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিন্তা-চেতনা, প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ের অভিব্যক্তি। এই স্বাধীনতা ও মুক্তির আন্দোলনে যেকোনো সশস্ত্র আক্রমণকে আমরা মোকাবিলা করবো তাঁরই নির্দেশে, ইঙ্গিতে এবং নেতৃত্বকে অনুসরণ করে।
নতুন প্রজন্ম আমাকে প্রশ্ন করতে পারে, সেই সশস্ত্র সংগ্রামে তো আপনারা যেতে বাধ্য হলেন, তাহলে ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত তাদেরকে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দিলেন কেন? ঐতিহাসিক বাস্তবতার আঙ্গিকে আমি পুনরায় উল্লেখ করতে চাই, পাকিস্তানের বর্বরোচিত সামরিক জান্তার শক্তির উৎস ছিল অস্ত্র ও অর্থ। তাদের চলার পথের বাহন ছিল ষড়যন্ত্র। আর আমাদের শক্তির উৎস ছিল বাংলার জনগণ।
যে কৃষক গ্রীষ্মের খররৌদ্রে হালচাষ করে, লাঙল চালায়, তার বুকভেজা ঘামের গন্ধে, যে মা মাঝ রাত্রে উঠে ধান সেদ্ধ করে, ঢেঁকিতে দাঁড়িয়ে পাড় দেয়; নকশিকাঁথায় ফুল তোলে, গ্রামের যে উদ্ধত যৌবনের মূর্তপ্রতীক তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে সর্বস্তরের উপার্জনের অবলম্বনে ব্যাপৃত, যে শিল্পী আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বাংলার প্রকৃতির ছবি আঁকে; একটি ভেজা কাকের মধ্যদিয়ে রূপসী বাংলার চিত্র ফুটিয়ে তোলে, যে কবি লিখে- পাথরের পর পাথর সাজাই/লিখে যাই নাম/সংগ্রাম সংগ্রাম সংগ্রাম, যে শিক্ষক জ্ঞানদানের মাঝে মাঝে হৃদয়ের বিস্তৃত ক্যানভাসে স্বাধীনতার বিমূর্ত ছবিটি দেখে উদ্বেলিত হয়, যে ছাত্র একসাগর রক্তের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে স্বাধীনতার সৈকতে পৌঁছাতে শপথ গ্রহণ করে, এদেশের কামার-কুমার, মাঝি-মাল্লা, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের বুকনিঃসৃত আশীর্বাদই আমাদের শক্তির উৎস বলে বারবার আমি উদ্ধৃত করতাম। আমরা অবহিত ছিলাম, তারা অস্ত্র আনছে, সংগঠিত হচ্ছে, চট্টগ্রামে অস্ত্র খালাস হচ্ছে, জয়দেবপুরে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে।
কিন্তু আমরা আস্তে আস্তে একেকটি অবরোধ, অসহযোগ, হরতালের কর্মসূচি দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় জনগণকে সংগঠিত করতে পেরেছিলাম বলেই ২৫শে মার্চের পৈশাচিক আক্রমণে মানুষ অকুতোভয়ে একযোগে মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সাহস পেয়েছিল। বাঙালি জাতির সর্বস্তরের মানুষ- ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, জনতা, সৈনিক, পুলিশ রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে গিয়ে একটি মিলনের মোহনায় একত্রিত হতে পেরেছিল। ফলে এই নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভার মতো বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আমরাই প্রজা্বলিত করতে পেরেছিলাম মুক্তিকামী জনতার ঐক্যের দাবানল। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে কোনো অপপ্রচারই সেই ঐক্যে চিড় ধরাতে পারেনি। বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। এটাই ছিল আমাদের জনশক্তিকে উজ্জীবিত করার সফলতা এবং ৭ই মার্চের ভাষণের অন্তর্নিহিত সত্য।
আরেকটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্যে যে চারটি শর্ত সংসদে বসার পূর্বশর্ত হিসেবে জুড়ে দিয়েছিলেন, আমরা নিশ্চিত ছিলাম ইয়াহিয়া খান সেটি মানতে পারবেন না। তবুও আন্তর্জাতিক জনমতের দিকে লক্ষ্য রেখে শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতায় এবং আমাদের রণকৌশলের মধ্যে পাকিস্তানি শক্তিকে অন্তরীণ ও অবরুদ্ধ করার কৌশল হিসেবে যা বলার ছিল তাই এতে অভিব্যক্ত হয়েছিল। আর অনুচ্চারিত অংশটুকু তার হৃদয়ের প্রতিধ্বনি হিসেবে উচ্চারিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কণ্ঠে। তাই বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের অনুরণন ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, আর তার গানের স্বরলিপি ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
লেখক: স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।