এমপি-কর্মকর্তা পক্ষপাত করলেই ব্যবস্থা

0
718
ইসিতে বিশেষ আইনশৃঙ্খলা বৈঠক  : সংসদ সদস্য বা রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচন প্রভাবিত করলে মামলা দায়ের ও ভোট বন্ধ

ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সহিংস ঘটনা ঘটলে ও নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে অভিযোগের মাত্রা অনুযায়ী প্রত্যাহার ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি সংসদ সদস্য (এমপি) বা রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা করলে ঘটনার গুরুত্ব অনুযায়ী মামলা দায়ের বা সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোট বন্ধ করা হবে।

বুধবার নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক বিশেষ সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেখানে কয়েকজন কর্মকর্তার বক্তব্যে বারবার আচরণবিধি লংঘনের ঘটনা উঠে আসে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে আরও কঠোর ও দ্রুত সিদ্ধান্ত দেওয়ার অনুরোধ জানান তারা। সভার পর বিকালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার ওসি নাসির উদ্দিনকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

বৈঠক সূত্র জানায়, নির্বাচনে সহিংসতা ও অনিয়মের ঘটনার তাৎক্ষণিক তথ্য না পাওয়ায় বৈঠকে অন্তত দুজন নির্বাচন কমিশনার অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, তাৎক্ষণিক তথ্য না পাওয়ায় নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিতে পারে না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে গিয়ে সময়ক্ষেপণ হয়। এছাড়া একজন নির্বাচন কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ, ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সমস্যা থাকার পরও তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে না আসায় হতাশা প্রকাশ করেন।

বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, একেক ধাপে অনেক বেশি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট থাকায় ফোর্স মোতায়েনে সমস্যা হচ্ছে। প্রতি ধাপে ৪০০ ইউপিতে ভোট করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েনে সুবিধা হয়।

চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাঝপথে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিশেষ এ সভা নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত হলো। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় নির্বাচন কমিশনাররা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, ইসি সচিব, র‌্যাব, আনসার ও গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই’র মহাপরিচালক, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের প্রতিনিধি এবং পুলিশের আইজির প্রতিনিধি অংশ নেন।

সভা শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা নির্বাচনে সহিংসতা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, আগামী নির্বাচনে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব সহিংসতা রোধ করার জন্য। একটাও সহিংস ঘটনা হবে না, মারামারি হবে না-এমন নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারি না। আমরা চেষ্টা করব এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।

তিনি বলেন, সহিংস ঘটনায় অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেককে গ্রেফতারের তৎপরতা চলছে। এলাকার মাস্তান যারা বিশৃঙ্খলা করতে পারে তাদের আগাম গ্রেফতারের জন্য ইন্সট্রাকশন (নির্দেশনা) দিয়েছি। তিনি জানান, সহিংসতা বন্ধে আগাম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তিনি। সিইসি বলেন, এমপি-মন্ত্রীদের অধিকাংশই আচরণবিধি অনুসরণ করেন। দু’চারজন সংসদ সদস্য মানছেন না বলে অভিযোগ এসেছে। তাদের চিঠিও দেওয়া হয়েছে এলাকা ছাড়ার জন্য। প্রত্যেকটি ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে অতীতে মামলা করা হয়েছে। তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, আগামীতেও প্রয়োজনে মামলা করা হবে।

সূত্র জানায়, বৈঠকে বক্তব্যে ঘুরেফিরে বারবার আচরণবিধি লংঘন ও কয়েকজন নির্বাচন কর্মকর্তাকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করার ঘটনা উঠে আসে। একজন কর্মকর্তা সংসদ সদস্যদের নাম উল্লেখ না করে বলেন, কিছু রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনে ডাবল স্ট্যান্ড নিচ্ছেন। একই উপজেলার কোনো ইউপিতে নৌকা প্রার্থীকে আবার কোনো ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেন। তার পছন্দের প্রার্থী জেতাতে নির্বাচনি কার্যক্রম প্রভাবিত করেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। এতেও সহিংস ঘটনা ঘটছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা বৈঠকে জানান, সবার ক্ষেত্রে আচরণবিধি সঠিকভাবে প্রতিপালন করা হলে সহিংসতা ও অনিয়ম কমে যাবে। এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন থেকে জানানো হয়, এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে গুরুত্ব অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা ও ভোট বন্ধ করা হবে বলে জানানো হয়।

বৈঠকে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচন ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। ভোটকেন্দ্রে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটলেই অনেক প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা পুলিশকে না জানিয়েই কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যান। এতে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। ওই অবস্থায় ভোটগ্রহণ বন্ধ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। ওই কর্মকর্তা গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পূর্ব অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নির্বাচনে দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেন।

আরও জানা গেছে, নির্বাচনে পক্ষপাতের অভিযোগ পেলে ইউএনও, ওসিসহ যে কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও পুলিশের পক্ষ থেকেও জানানো হয়, কমিশনের নির্দেশনা পেলে যে কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে তারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চান। এতে অন্যরাও দায়িত্ব পালনে সচেতন হবে।

অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় ‘নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেন তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বৈঠকে জানানো হয়, এবার প্রতিটি ধাপে অনেক বেশি সংখ্যক ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে এতসংখ্যক ফোর্স দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। তারা জানান, প্রতিটি ধাপে চারশ’ ইউপিতে ভোট হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েনে সুবিধা হয়। বৈঠকে কেন্দ্রে ফোর্স কমিয়ে টহল ফোর্স বাড়ানোরও প্রস্তাব করা হয়। ইসি সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকের পরই কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার একজন ওসি নাসির উদ্দিনকে বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ওই ওসি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে অন্তরায় বলে তথ্য পেয়েছে কমিশন।

বৈঠক সূত্রে আরও জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ও কবিতা খানম নির্বাচনে অনিয়ম ও সহিংস ঘটনায় তাৎক্ষণিক তথ্য না পাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সময়মতো আমরা তথ্য জানতে পারি না। মাঠ প্রশাসন থেকে আমাদের তথ্য দেওয়া হয় না। গণমাধ্যম বা অন্যান্য মাধ্যমে আমাদের কাছে খবর আসে। ওই খবর অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে গিয়ে সময়ক্ষেপণ হয়। এ কারণে অনেক ঘটনার ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নষ্ট হয়। ইসির একজন কর্মকর্তা বলেন, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ঝামেলা রয়েছে। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার কোনো প্রতিবেদনে তা উঠে আসেনি। এতে প্রস্তুতি নিতে সমস্যা হচ্ছে।

আলোচনার বিষয়ে বৈঠকের পর সিইসি আরও বলেন, সামগ্রিক অর্থে নির্বাচন সফল হয়েছে। অল্প বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনা ঘটেছে, হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। যেগুলো কিছুতেই কাম্য নয়। তবুও নির্বাচনের মানদণ্ড যদি ভোট প্রদান হয়, তাহলে আমি বলব, গত নির্বাচনগুলোয় গড়ে ৭৪ শতাংশ ভোট পড়েছে।

তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে উত্তেজনা বিরাজ করে, উত্তাপ বিরাজ করে। সেই উত্তেজনা ও উত্তাপ কখনো কখনো সহিংসতায় পরিণত হয়ে যায়; যা কখনোই আমাদের কাম্য নয়। সহিংসতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা দেখেছি যে কোথাও কোথাও মারামারি হয়েছে, খুন জখম হয়েছে। তার পরও স্থানীয় প্রশাসন পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে নির্বাচন চালু রেখেছে এবং সেই নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট সম্পন্ন হয়েছে। আচরণবিধি প্রতিপালনে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সহিংসতা ঘটতে পারে এমন পকেটগুলো চিহ্নিত করে আগাম গোয়েন্দা তথ্য নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানা ও দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। সূত্র: যুগান্তর।