স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার এতিমদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। এতিমদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় “স্মার্ট কর্পোরেট ক্লিনিক” সাথে একটি স্বাস্থ্যসেবা চুক্তি স্বাক্ষরিত করেছেন এতিমখানা প্রশাসক ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর আজিমপুরে স্যার সলিমুল্লাহ এতিমখানায় এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তির ফলে স্মার্ট কর্পোরেট ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য মাসিক ৯০ টাকার বিনিময়ে প্রতিটি এতিম বালক বালিকা ও প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তা কর্মচারিরা একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চয়তা পেয়েছে।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোন বালক বালিকা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারো যদি বছরে তিনবার হাসপাতালে ভর্তি হয় তাহলে প্রতিবার ১০ হাজার টাকা করে বিল কাভারেজ পাবেন। সারাবছর চিকিৎসা পরামর্শের পাশাপাশি দেশব্যাপি ১৬০ টিরও বেশি হাসপাতালে যে কোন রোগের জন্য চিকিৎসা নিতে পারবেন।
এছাড়া ১৮টি জটিল রোগের জন্য এককালিন ২৫ হাজার টাকার অর্থিক সহযোগিতা দেয়া হবে। দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যু হলে ১ লাখ টাকা দেয়া হবে। স্বাভাবিক মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব বরণ করলে ৫০ হাজার টাকার কাভারেজ পাবে। এছাড়া বাসা বা অফিসে বসেই ৬৫ শতাংশ মূল্য ছাড়ে বছরব্যাপী ৮ হাজার টাকার পরিক্ষা-নিরিক্ষা করতে পারবে যে কেউ। একজন ডাক্তার ও একজন প্যারামেডিকেল নার্স মাসে দুইদিন এতিমখানায় চিকিৎসা সেবা প্রদান করবেন। এছাড়া টেলিমেডিসিনের ব্যবস্থাও থাকবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সমাজ সেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) সৈয়দ মো. নূরুল বাসির, অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী (পরিচালক প্রতিষ্ঠান), বিশেষ অতিথি ছিলেন, হাসিবুর রহমান মানিক কাউন্সিলর (২৬ নং ওয়ার্ড) ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, স্মার্ট কর্পোরেট ক্লিনিকের প্রজেক্ট চীফ ও হেড অফ বিজনেস অলোক কুমার বিশ্বাস ও সমাজ সেবার উপ-পরিচালক (ঢাকা জেলা) মো. রকনুল হক।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সৈয়দ মো. নূরুল বাসির বলেন, জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো। এতিমখানা থেকে বের হয়ে অনেকেই বড় বড় জায়গায় অবস্থান করছে। সবার আগে মানুষ হতে হবে। এমনও দেখেছি ভাগ্যের পরিহাসে অনেক মানুষ প্রাসাদ ছেড়ে রাস্তায় চলে এসেছে আবার রাস্তার মানুষ প্রাসাদে উঠে গেছে। আমার সহকর্মী কামরুল ইসলাম চৌধুরী একজন উদ্যোগি মানুষ, চ্যালেঞ্জ নিতে জানে, তার সাহসী উদ্যোগে এতিমখানাটি অনেক এগিয়ে গেছে ভবিষৎতে আরও এগিয়ে যাবে বলে আশা করছি।
রোকনুল হক বলেন, একটা সময় ছিলো অঝোরে ঝরে পড়েছিলো প্রতিষ্ঠানটি কেউ দেখার ছিলো না, এমনকি দেখতেও চায়নি। দিনদিন ছাত্রছাত্রী কমেছে। কিন্তু কামরুল ইসলাম স্যারের কারণে প্রতিষ্ঠানটি আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ভালো উদ্যোগ নিতে মন লাগে, সাহস লাগে এটা সবাই পারে না। বাংলাদেশে অনেক অবহেলিত মানুষ আছে যাদের থাকা-খাওয়ার জায়গা নেই তাদেরকে খুঁজে নিয়ে আসতে হবে।
সভাপতির বক্তবে কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এ এতিমখানায় যেদিন প্রথম এসেছিলাম সেদিন আমার চোখে ধরা পড়লো জরাজির্ন চিকিৎসা ঘরের সাইনবোর্ড। দেখে মনে হচ্ছিলো পরিত্যাক্ত কোন ভবন। তখন আমার কৌতুহল জাগলো ভিতরের অবস্থা দেখার। পরে দেখি চাবি খুঁজে পাচ্ছে না, তালার উপরে ধুলাবালুর আস্তরণ পড়ে আছে। ভিতরে দেখে মনে হচ্ছিলো একটা সময় এখানে ডাক্তার বসতো। কিন্তু বর্তমানে রুমের চেয়ার টেবিল দেখলে অসুস্থ হওয়ার অবস্থা। অস্বাস্থ্যকর একটা পরিবেশ। তখনই আমার মনে হলো এখানে আবারও চিকিৎসা ব্যবস্থা সচল করা দরকার। কারণ আমাদের নিবাসিরা যদি হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে পড়ে তাহলে যাবে কোথায়। তারা যদি নিয়মিত চেকআপ করে তাহলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমে যাবে। সে চিন্তা থেকেই আমার এ উদ্যোগ। এখানে প্রতি মাসে দুই দিন আমরা একজন ডাক্টার ও একজন প্যারামেডিকেল নার্স পাবো। যেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ সবাই চেকআপ করতে পারবে। এতিমদের কেউ অসুস্থ হলে তাকে তাৎক্ষণিক মেডিকেলে নেয়ার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স কেনারও প্রক্রিয়া চলছে। যাতে এতিমখানার কেউ অসুস্থ হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া যায়। এতিমখানার উন্নয়নে আরও পরিকল্পনা রয়েছে। এটি হবে একটি মডেল এতিমখানা।
স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার আদর্শ ও উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের অসহায় এতিম শিশুদের লেখাপড়া, খেলাধুলা, শরীর চর্চা, সাংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্য ইত্যাদি শিক্ষা দানের মাধ্যমে এমন প্রচেষ্টা নেওয়া যাহাতে অত্র প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি পোষ্য একজন উপযুক্ত নাগরিক হিসাবে জাতীয় পূর্ণগঠন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় রোধে ভূমিকা রাখতে পারে।
উল্লেখ্য: আভিজাত্যের প্রাচীর ডিঙিয়ে খাজা সলিমুল্লাহ সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশতেন। ১৯০১ সালে পিতা নওয়াব স্যার খাজা আহসানুল্লাহর মৃত্যুর পর জীবিত জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে তিনি ঢাকা নওয়াবের কর্তৃত্ব লাভ করেন। ১৯০৯ সালে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ আহসান মঞ্জিলের পাশে কুমারটুলির একটি ভাড়া বাড়িতে এতিমখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এতিমখানার পরিসর বাড়লে ১৯১৩ সালে এটিকে লালবাগের কাছে আজিমপুরে স্থানান্তর করা হয়। ওই বছরই গভর্নর লর্ড কারমাইকেল এতিমখানাটি পরিদর্শন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নবাব সলিমুল্লাহই এতিমখানার যাবতীয় খরচ দিতেন। ১৯১৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পর এতিমখানা অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। তখন ঢাকার অনেকেই আর্থিক সহযোগিতা করেন। এ সময়ে এতিমখানার নামকরণ করা হয় স্যার সলিমুল্লাহ এতিমখানা। ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় আর্থিক সংকটে পড়লে সলিমুল্লাহর প্রথম সন্তান নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহ বাহাদুরকে এতিমখানার কমিটির সভাপতি এবং মৌলভী চৌধুরী ফরিদ উদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এই কমিটি আজিমপুরের বর্তমান জায়গায় ২১ বিঘা জায়গা কিনে সেখানে এতিমখানাটি প্রতিষ্ঠান করেন।
১৯৫৮ সালে নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মেজর নবাব খাজা হাসান আসকারী এতিমখানার সভাপতি হন। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি এতিমখানাটি চালালেও পরে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান। ইতিমধ্যে কয়েক দফায় কমিটি বদলায়। ২০০৩ সালে সেই সময়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি এতিমখানার দুই বিঘা জমি একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দিলে শিক্ষার্থীরা আদালতে যায়। আদালত ওই ভবনসহ জায়গা এতিমখানাকে ফিরিয়ে দিতে বলেন। ২০০৮ সালের ২ জানুয়ারি সরকার কমিটি বিলুপ্ত করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে সলিমুল্লাহ এতিমখানা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী এতিমখানাটি দেখভাল করছেন। এই এতিমখানায় কেজি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত অনাথ ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে পারে। এখানকার শিক্ষার্থীরা এখন রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আছেন। ইডেন কলেজের পর আজিমপুরের রাস্তাটি এখনো এতিমখানা রোড নামেই পরিচিত।